শবে বরাত কিংবা মধ্য শা'বান (আরবিঃ نصف شعبان, প্রতিবর্ণী নিসফে শাবান) কিংবা লাইলাতুল বরাত
শবে বরাত কি
শবে বরাত কিংবা মধ্য শা'বান (আরবিঃ نصف شعبان, প্রতিবর্ণী নিসফে শাবান) কিংবা লাইলাতুল বরাত হচ্ছে হিজরী শা'বান মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মধ্যবর্তী রাতে পালিত মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ রাত।উপমহাদেশে এই রাতকে শবে বরাত বলা হয়। ইসলামী বিশ্বাস মতে এই রাতে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অনেক মুসলমান নফল ইবাদাতের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করেন। অনেক অঞ্চলে এই রাতে তাঁদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।বারো শিয়া মুসলিমরা এই তারিখে মুহাম্মদ আল-মাহদির জন্মদিন উদ্যাপন করে।তবে সালাফিরা এর বিরোধিতা করে থাকেন।
উৎস!
শবে-বরাত হলো একটি ফার্সি শব্দ।যার কারণে শবে-বরাত শব্দের ব্যবহার আরবীতে নেই। তবে শাবান মাসের অনেক গুরুত্ব বা ফযিলত রয়েছে। শাবান মাসের মধ্য তারিখের গুরুত্ব রয়েছে।
হাদিস!
সিহাহ সিত্তাহ কিংবা বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিসগ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। হাদিসগুলোর সনদ বিভিন্ন মানের এবং এবিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান। হাদিস শাস্ত্রে শবে বরাত বলতে যে পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো নিসফ শাবান কিংবা লাইলাতুন নিসফি মিন শা'বান তথা শা'বান মাসের মধ্য রজনী । একটি হাদীসে বলা হয়েছে
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক এবং হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন।
📗 [ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫.বাযযার, আল মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬.আহমদ ইবনু হাম্বল আল মুসনাদ ২/১৭৬.ইবনু আবি আসিম, আস সুন্নাহ .পৃ ২২৩-২২৪.ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১২/৪৮১.তাবরানী, আল-মুজাম আল-কাবীর, ২০/১০৮, ২২/২২৩.আল-মুজাম আল-আওসাত, ৭/৬৮.বায়হাক্বী, শু’আবুল ঈমান, ৩/৩৮১.ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬।)[সনদ সহীহ]
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্নিত আছে যে মুহাম্মাদ (সঃ) এই মাসে অনেক বেশি নফল রোযা পালন করতেন। শাবান মাসের রোযা ছিল তার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। এই মাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত ও কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল রোজা পালন করতেন।
👳এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ
📗এই মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়।এবং আমি ভালবাসি যে আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।
(নাসাঈ, আস-সুনান ৪/২০১.আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৪৭।[সনদ হাসান]
হাদিস অনুসারে এই রাত দোয়া কবুল, ক্ষমা প্রার্থনা সহ আল্লাহ'র কাছে চাওয়ার রাত। যথাঃ
অর্থঃআলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেনঃ
আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব। এভাবে ফজরের সময় পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। [ইবনে মাজাহ এবং বাইহাকী]
আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে আসেন। আর প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অন্তর্ভুক্ত। অতএব এই হাদীসের মতে অন্যান্য রাতের মত শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আসমানে আসেন।
তাকি উসমানি বলেন, এ কথা বলা একেবারেই ভুল যে, শবেবরাত কোন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং আসল সত্য হল, ১০ জন সাহাবি থেকে এই হাদিস বর্ণিত আছে। যে হাদিসগুলোয় নবী করীম (সাঃ) এই রাতের ফজিলত বর্ণনা করেছেন। সেই হাদিসগুলোর মধ্যে কিছু হাদিস সনদের দিক থেকে যদিও কিছুটা দূর্বল। যার কারণে কয়েকজন আলেম বলেছেন এই রাতের ফজিলতের কথা ভিত্তিহীন। কিন্তু এর স্বপক্ষে অন্য অনেক হাদিস পাওয়া যায়। যার মাধ্যমে সেগুলোর দূর্বলতা দূর হয়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ তাকদ্বীর এর পরিচিতি।
সম্পর্কিত প্রথা !
ভারত.পাকিস্তান.বাংলাদেশ.শ্রীলঙ্কা.লেবানন.ইরান.আজারবাইজান.তুরস্ক.আফগানিস্তান.উজবেকিস্তান.তাজিকিস্তান.কাজাকিস্তান.তুর্কমেনিস্তান এবং কিরগিজস্তান এ মধ্য শাবান উদযাপিত হয়। সালাফি আরবগণ এই দিনটি পালন করে না।তাদের মতে এইরাতে বিশেষ কোনো ইবাদাতের নির্দেশ নেই। আরব বিশ্বে, সুফি ঐতিহ্যের আরবেরা ও শিয়ারা এই উৎসব পালন করে।
ইরানে বারো ইমাম শিয়ারা শিয়া মতবাদের দ্বাদশ ইমাম মাহদির জন্মদিন হিসেবে এই দিনটি পালন করে থাকেন। এই রাতে ইরানের সব কিছু আলোক সাজসজ্জা করাহয়।দোয়া মাহফিলের আয়োজনও করা হয়।ইরাকে এই দিনে বাচ্চারা প্রতিবেশীদের বাড়ি গেলে তাদেরকে মিষ্টিমন্ডা খাওয়ানো হয়। ইরাকি কুর্দিস্তান এবং আফগানিস্তানের সুন্নি মুসলিমগণ রমযানের পঁনের দিন আগে এই পবিত্রদিনটি পালন করেন।
বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাত উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন স্বাদের খাবার। এসবের মধ্যে রয়েছে রুটি, বিভিন্ন রুচির হালুয়া.সুজি.মিষ্টান্ন। বিকেলে বা সন্ধ্যায় পাড়া প্রতিবেশিদের মাঝে এসব খাবার বিতরণ ও পরিবেশন করা হয়। শবে বরাত উপলক্ষে বাংলাদেশের সরকারি বেসরকারি বেতার এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। জাতীয় পত্রিকাগুলো এ দিন বিশেষ ক্রোড়পত্র ও সাময়িকী প্রকাশ করে। শবে বরাতের পর আসন্ন দিনটি বাংলাদেশে সাধারণ ছুটির দিন হিসবে পালিত হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় কিছু মুসলমান মসজিদে উস্তাদ বা জাভা ও মাদুরায় কায়ি নামে পরিচিত ধর্মীয় নেতার বক্তৃতা (সেরামাহ) শোনে ও দলীয়ভাবে জিকির করে। ইন্দোনেশিয়ায় এই প্রথা পালিত হয় না বললেই চলে, তবে আচেহ, পশ্চিম সুমাত্রা ও দক্ষিণ কালিমান্তা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পালিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমগণ মিষ্টান্ন বানায় (বিশেষত হালুয়া বা জর্দা) ১৫ই শাবান সন্ধ্যার সময় প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের দেওয়ার জন্য। বসনিয়াতেও শাবানের পঁনের তম রাতে হালুয়া বিতরণের এই প্রথা পালন করা হয় ও বাকি তিনটি পবিত্র দিনেও হালুয়া বিতরণ করা হয়ে থাকে শবে কদর, শবে মেরাজ এবং লাইলাতুল রাগাইব।
এ নামাযের প্রথম প্রচলন
এ নামাযের প্রথম প্রচলন হয় হিজরী ৪৪৮ সনে। ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের ইবনে আবিল হামরা নামীয় একলোক বায়তুল মুকাদ্দাস আসেন। তার তিলাওয়াত ছিল সুমধুর। তিনি শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে নামাযে দাঁড়ালে তার পিছনে এক লোক এসে দাঁড়ায়, তারপর তার সাথে তৃতীয় জন এসে যোগ দেয়, তারপর চতুর্থ জন। তিনি নামায শেষ করার আগেই বিরাট একদল লোক এসে তার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।
আরো পড়ুনঃ জানাজার নামাজ কি? পড়ার নিয়ম-কানুন এবং দোয়া।
এ নামাযের পদ্ধতি
প্রথা অনুসারে এ নামাযের পদ্ধতিটি হচ্ছে, প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার একবার পড়ার পর সূরা ইখলাস দশবার করে পড়ে মোট একশত রাকাত নামাজ পড়াতে হবে। যাতে করে সূরা ইখলাস এক হাজার বার পড়া হয়। (এহইয়ায়ে উলুমুদ্দীন (১/২০৩)।
এ ধরণের নামায সম্পূর্ণ বিদ‘আত। কারণ এ ধরণের নামাযের বর্ণনা কোন হাদীসের কিতাবে আসেনি। কোন কোন বইয়ে এ সম্পর্কে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয় সেগুলো কোন হাদীসের কিতাবে আসেনি।
👳আর তাই আল্লামা ইবনুল জাওযী (মাওদু‘আত ১/১২৭-১৩০), হাফেয ইরাকী (তাখরীজুল এহইয়া), ইমাম নববী (আল-মাজমু‘ ৪/৫৬), আল্লামা আবু শামাহ (আল-বা‘েয়স পৃঃ৩২-৩৬), শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা, (ইকতিদায়ে ছিরাতুল মুস্তাকীম ২/৬২৮),
👳আল্লামা ইবনে ‘আররাক (তানযীহুশ শরীয়াহ ২/৯২), ইবনে হাজার আল-আসকালানী, আল্লামা সূয়ূতী (আল-আমর বিল ইত্তেবা পৃঃ৮১, আল-লাআলিল মাসনূ‘আ ২/৫৭), আল্লামা শাওকানী (ফাওয়ায়েদুল মাজমু‘আ পৃঃ৫১) সহ আরো অনেকেই এ গুলোকে “বানোয়াট হাদীস” বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন।