রোজা বা সিয়াম সর্ম্পকে আলোচনা -
রোজা বা সিয়াম সর্ম্পেক আলোচনা
⌚রোজা বা সিয়াম ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়। সুবহে সাদেক বা ভোরের সূক্ষ আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম হচ্ছে রোযা। ইসলামী বিধান অনুসারে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমযান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ যার অর্থ অবশ্য পালনীয়।
⏰কিছু মুসলিম আলেম মূল ইসলামী আরবী শব্দ সাওম বা সিয়াম এর ব্যবহারকে অধিক উৎসাহিত করে থাকেন।যুক্তি হিসেবে তারা বলেন সাওম শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই শব্দটি বলার সময় প্রতি হরফে দশ নেকি করে তিন হরফে মোট ৩০ নেকি সাওয়াব পাওয়া যাবে। যা রোজা কিংবা অন্যান্য কুরআনীয় প্রতিশব্দ উচ্চারণে পাওয়া যাবে না। কুরআনীয় শব্দ বলায় প্রতি হরফে দশ নেকির ক্ষেত্রে তারা ইসলামী নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর উক্ত হাদীসটি পেশ করেন।
রোজা সর্ম্পেক হাদিস
রাসূল (সা.) বলেছেন !
📘আল্লাহ তাআলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্যে এর সওয়াব রয়েছে।এবং দশ গুণ হিসেবে এর সওয়াব হয়।আমি বলি না যে, আলিফ_লাম_মীম একটি হরফ বরং আলিফ একটি হরফ.লাম একটি হরফ ও মীম একটি হরফ।
(সুনানে তিরমিযি, হাদিস: ২৯১০)
রোযার আরবি নিয়ত
রোজার নিয়তের বাংলা
উচ্চারণঃনাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম, মিন শাহরি রমাদানাল মুবারাক; ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস সামিউল আলিম।
রোজার ফযিলত
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বলেনঃ
💧ঈমানের সাথে ছাওয়াবের আশায় যেই ব্যক্তি রোযা পালন করে তাহার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
👳আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শয়তান এবং দুষ্ট জিনদেরকে রামাযান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং এর দরজাও তখন আর খোলা হয় না ।খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো এবং এর একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। এই মাসে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেনঃ হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত খারাপ কিছু থেকে বিরত হও। এবং অনেক লোককে আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ হতে এই মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এবং প্রতি রাতেই এরূপ হতে থাকে।
আরো পড়ুনঃ ইসলাম কি?
👳আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর মর্জি হলে আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকাজের প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আল্লাহ্ বলেনঃ তবে রোযা ব্যতীত, তা আমার জন্যই রাখা হয়।এবং আমিই তার প্রতিদান দিবো। সে তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই ত্যাগ করে। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দঃ একটি আনন্দ তার ইফতারের সময় এবং আরেকটি আনন্দ রয়েছে তার প্রভু আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাতের সময়। রোযাদার ব্যক্তির মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্তুরীর ঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুগন্ধময়।
👴আবদুল্লাহ ইবনু উমার হতে বর্ণিত আছে যে. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে। (সিয়াম বলবে)হে রব! আমি তাকে দিনে খাবার গ্রহণ করতে এবং প্রবৃত্তির তাড়না মিটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার শাফা‘আত কবূল করুন।এবং (কুরআন বলবে)হে রব! আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে।
আরো পড়ুনঃতাকদ্বীর এর পরিচিতি।
রোযার উৎপত্তিঃ
📘মূল কুরআনীয় ইসলামী আরবিতে ইসলামী উপবাসের নাম সাওম, বহুবচনে সিয়াম, যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণ বা বিরত থাকা। রোজা শব্দটি ফারসি শব্দ, যা এসেছে আদি-ইরানীয় ধাতুমূল রোওচাকাহ থেকে, যার অর্থ উপবাস, যা আবার এসেছে ইন্দো-ইরানীয় ধাতুমূল রোচস থেকে। যার অর্থ দিন বা আলো। ফারসি ভাষায় সিয়ামের প্রতিশব্দ হিসেবে রোজা ব্যবহৃত হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ভাষার মত কালক্রমে বাংলা ভাষাতেও শত শত বছর আগে থেকে এখন পর্যন্ত সাওম বা সিয়াম নামক ইসলামী উপবাস বোঝানোর জন্য সমধিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,কামাচার, পাপাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ বিলাস এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম হচ্ছে রোজা।
আরো পড়ুনঃজানাজার নামাজ কি? পড়ার নিয়ম-কানুন এবং দোয়া।
রোজার ইতিহাস
কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে
📔হে যারা ঈমান!এনেছ তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে ।যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরে ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাক্ওয়া অবলম্বন করতে পারো।সূরা বাকারা: ১৮৩
👳হযরত আদম (আঃ) নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পরে যখন তাওবাহ করেছিলেন তখন ৩০ দিন পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা তাহার তাওবাহ কবুল করেন নাই।৩০ দিন পর তারার তাওবাহ আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন।তারপরে তার সন্তানদের উপর ৩০টি রোযা ফরয করে দেওয়া হয়।।
📗নূহ (আঃ)এর যুগেও রোজা ছিল। কারণ রাসুলুল্লাহ (সঃ)বলেছেনঃ
👉হযরত নূহ (আঃ)এক লা শাওয়াল এবং দশ জিলহজ ছাড়া,সারা বছর রোযা রাখতেন।
👉ইবনে মাজাহ ১৭১৪ (সনদ দুর্বল)
👉হযরত ইবরাহীম (আঃ)এর জামানায় ৩০টি রোজা ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছিলেন।
👴হযরত দাউদ (আঃ)এর যুগেও রোযার প্রচলন ছিল। হাদিসে বলা হয়েছে যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোযা হযরত দাউদ (আঃ)এর রোযা। তিনি একদিন রোযা রাখতেন ও একদিন রোযা রাখতেন না বিনা রোযায় থাকতেন।
📖আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোযা সম্পর্কে কমবেশী ওয়াকিফহাল ছিলেন।মক্কার কুরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০এ মুহররম) দিনে এই জন্যে রোযা রাখতেন যে এই দিনে খানা কাবার ওপরে নতুন গেলাফ চড়ানো হতো।মদীনায় বসবাসকারী ইহুদীরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করতো।অর্থাৎ ইহুদীরা নিজেদের গণনানুসারে সপ্তম মাসের ১০ম দিনে রোযা রাখতো।
রোযার শর্ত হলোঃ
📖রোজার কিছু মৌলিক আচার আছে। যা ফরজ বলে চিহ্নিত। সুস্থ-সবল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। কিন্তু শারীরিক অসমর্থতার কারণে সে এ দায়িত্ব থেকে আপাতভাবে মুক্তি পেতে পারে। এর প্রতিবিধানে রয়েছে কাজা এবং কাফফারার বিধান এবং নিচে রোজার ফরজ ও শর্তগুলো দেওয়া হলো
রোজার ৩টি ফরজঃ
👉নিয়ত করা
👉সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা
👉যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা।
রোজা রাখার ৪টি শর্তঃ
👊মুসলিম হওয়া
👊বালেগ হওয়া
👊অক্ষম না হওয়া
👊ঋতুস্রাব থেকে বিরত থাকা নারী।
রোজা পাঁচ প্রকার।
👂ফরজ রোজাঃ যা আবার চার প্রকার
রমজান মাসের রোজা।
কোনএক কারণ বশত রমজানের রোজা ভঙ্গ হয়ে গেলে তার কাযা আদায়ে রোজা রাখতে হবে।
শরীয়তে স্বীকৃত কারণ ব্যতীত রমজানের রোজা ছেড়ে দিলে কাফফারা হিসেবে ৬০টি রোজা রাখা।
রোজার মান্নত করলে তা আদায় করতে হবে।
👂ওয়াজিব রোজাঃ নফল রোজা রাখার পরে ভঙ্গলে পরবর্তীতে তা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
👂সুন্নত রোজাঃ মহরম মাসের ৯এবং ১০ তারিখে রোজা রাখা।
👂মোস্তাহাব রোজাঃপ্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, এবং ১৫ তারিখে, প্রতি সাপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারে, কোন কোন ইমামের মতে শাওয়াল মাসে পৃথক পৃথক প্রতি সপ্তাহে দুটো করে ছয়টি রোজা রাখা মোস্তাহাব। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)এর মতে এক সাথে হোক বা পৃথক পৃথক ভাবেই হোক না কেন শাওয়ালের ৬ টি রোজা মুস্তাহাব।
👂নফল রোজাঃমোস্তাহাব আর নফল খুব কাছাকাছির ইবাদত। সহজ অর্থে নফল হলো যা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত নয় এমন ইবাদত পূণ্যের নিয়তে করা। রোজার ক্ষেত্রেও তাই।
রোজা ভঙ্গ হলে করনীয়ঃ
💫কোনো কারন ছাড়া রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যত গুলো রোজা ভঙ্গ হবে।ঠিক ততো গুলো রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা ১ টির পরিবর্তে ১টি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু ১ টি রোজাই যথেষ্ট। কাফফারা আদায় করার ৩ টি বিধান রয়েছে।
কাফফারা অর্থ হলোঃ
👉কাফফারা (কাফফরাহ নামেও পরিচিত) হল অভাবগ্রস্তদের সহায়তা করার জন্য অর্থ বা খাবার সমন্বিত একটি ধর্মীয় অনুদান। যখন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন রোজা বাদ দেয় বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে রোজা ভঙ্গ করে (যেমন সহবাস করা কিংবা খাবার খাওয়া) ঔ সময়ে তখন কাফফারা দেওয়া হয়।
কাফফারা আদায় করার ৩ টি বিধান হলোঃ
👍কাফফারা তিনভাবে আদায় করা যায়। একটি দাসমুক্ত করা, ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা ভালোভাবে তৃপ্তিসহকারে আহার করানো এবং ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজা পালন করা। যে কয়টি রোজা রাখার পর ওজর ছাড়া ভাঙবে।ঠিক ততটির প্রতিটির পরিবর্তে ১ টি করে কাজা ও একই রমজান মাসের জন্য তার সাথে যুক্ত হবে ১টি কাফফারা
👌অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায় একইভাবে রমজান পালন করে তবে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, সুন্নিগণ সূর্যাস্তের সময় তাঁদের রোজা বা উপবাস ভাঙে, যখন একেবারই সূর্য আর দেখা যায় না, তবে আকাশে তখনও আলো থাকে। তবে শিয়া সম্প্রদায় রোজা উপবাস ভাঙ্গার জন্য সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। শিয়া মুসলিমগণ একটি অতিরিক্ত ছুটি পালন করে যা সুন্নি সম্প্রদায় করে না।
👳সুফী মুসলিমরা কীভাবে রমজান পালন করে এবং রমজান তাদের কাছে কী অর্থ বহন করে সে ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। রোজা রাখার সময় তাঁরা একই নিয়ম অনুসরণ করে তবে মধ্যরাতে অতিরিক্ত নামাজ পড়ে। তারা যে প্রার্থনা করে তাদের নাম জিকির, যেখানে তাঁরা ৯৯ বার আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তাঁরা এরূপ করে, কারণ এর মাধ্যমে তাঁরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁদের ভালবাসা প্রদর্শন করেন ও সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যক্তিগত নৈকট্য লাভ করতে চান।
ঈদ উল-ফিতরঃ
মূল নিবন্ধ: ঈদ উল-ফিতর
দীর্ঘ একমাস রোজা পালনের পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে মুসলিমদের ঈদ উল-ফিতর (আরবি: عيد الفطر ) পালন করা রমজান মাসের রোজা শেষ হওয়াকে চিহ্নিত করে।